লে থেকে ৫০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পেরিয়ে খারদুংলা টপ। বিশ্বের উচ্চতম যানোপযোগী পথ বলে খ্যাত সেই স্থানের হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডাও মনে থাকে বহুদিন। খারদুংলা পেরিয়ে একে একে খালসার, হুন্ডার, পানামিক। খালসারের কাছেই নুব্রা নদী স্বচ্ছতোয়া শিয়ক নদীর সাথে মিশেছে। শিয়ক নদীর ওপর সেতু পেরুলেই শীতল মরুভূমি। সেখানকার দু’কুঁজো উট, সবুজ মরূদ্যান, উষ্ণপ্রস্রবণ – সব মিলিয়ে এ এক অচিন দেশের ভ্রমণকথা।

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। পাঁচ বন্ধু মিলে আমরা চলেছি লাদাখ দর্শনে। নভেম্বর থেকে মে – এই সময় লাদাখ যাওয়ার সমস্ত সড়কপথই বন্ধ থাকে। অগত্যা কলকাতার হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি পৌঁছলাম এবং তারপর প্রায় দেড় ঘণ্টার আকাশপথ পাড়ি দিয়ে ছোট বিমানটি আমাদের নিয়ে অবতরণ করল সিন্ধু তীরবর্তী লে বিমানবন্দরে। চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা এয়ারপোর্ট থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে

পাখির চোখে দেখা জাঁস্কার পর্বতমালা

১ডি নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগোলে শহরের প্রাণকেন্দ্র লে বাজার। এখানে বিভিন্ন ভাড়ার হোটেল পাওয়া যায়। আমরা বাজার সংলগ্ন একটা দ্বিতল হোটেলে উঠলাম। শহরের উচ্চতা ১১,৪৮৩ ফুট। উচ্চতাজনিত সমস্যা এড়াতে ও বিমানবন্দরে নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দিতে সারাটা দিন হোটেলেই রইলাম।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল হোটেলসংলগ্ন সবেদা গাছে নাম না জানা পাখিদের ঝগড়া-ঝাঁটিতে। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখতে পেলাম লাদাখ পর্বতমালার চূড়ার ওপর ধূসর আর সাদা রঙের খেলা চলছে।

ইনারলাইন পারমিটের ব্যবস্থা সেরে লে শহরে দু’দিন বিশ্রাম নিয়ে এই উচ্চতায় শরীরকে খাপ খাইয়ে আরো দু’দিনের সফরে চললাম খারদুংলা ও নুব্রা ভ্যালির পথে। লে শহরের উত্তরে এই রাস্তা বেশ চড়াই। পাঁচ বন্ধু ছাড়া এই ভ্রমণপথের সঙ্গী ড্রাইভার-কাম-গাইড ইকবাল ভাই। তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ ১০ বছরের।

লেহ শহরে উইলো গাছের মিছিল

সময়ের সাথে সাথে বাদামি ধূসর পাহাড়গুলো ক্রমে অদৃশ্য হয়ে গেল ও তুষারশুভ্র পাহাড় তার জায়গা নিতে থাকল। বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়ের গায়ে তৈরি সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে আমাদের গাড়িটা ধীরগতিতে এগিয়ে চলল। রাস্তার ওপর এ দিক-ও দিক ছড়িয়ে থাকা পেঁজা তুলোর মতো বরফ সূর্যের আলো ফোটার সাথে সাথে পানির ধারার সৃষ্টি করছে। রাস্তার পাহাড়ের দিকের অংশে পাহাড় চুঁইয়ে গড়িয়ে আসা পানি জমাট বেঁধে স্ফটিকের আকার নিয়েছে, আর তার ওপর সকালের সূর্যকিরণ বিচ্ছুরিত হয়ে রামধনু রঙ ছড়াচ্ছে। রাস্তার অন্য দিকে অর্থাৎ খাদের দিকের অংশে প্রকৃতি বরফের হরেকরকম স্থাপত্য রচনা করেছে।

প্রায় ৩০ কিলোমিটার চলার পরে আমরা পৌঁছলাম খারদুংলা পাসেÑ উচ্চতা ১৪,৭৩০ ফুট। দলের সবারই উচ্চতার কারণে অল্পবিস্তর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর গাড়ি চড়াই পথে আরো ওপরে উঠতে থাকল। একেক জায়গায় পাহাড়ি ঝরনা বরফের আকার নিয়ে আমাদের যেন ফিরে যেতে বলছে। হঠাৎ রাস্তার এক বাঁকে এরকমই এক কঠিন ঝরনার ওপর দিয়ে চলতে গিয়ে বিপদে পড়লাম। ইকবাল ভাই স্টিয়ারিংটা ডানদিকে ঘোরাতেই জমাটবাঁধা পুরু বরফে গাড়ি পেছনের চাকা পিছলে গিয়ে ক্রমশ খাদের দিকে হড়কাতে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে সবার হৃদস্পন্দন যেন কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। সাথীদের একজন চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলÑ ব্রেক দাবাও। ইকবাল পাল্টা ধমক দিলÑ চুপ রহো! তারপর অ্যাকসিলারেটরে জোরে চাপ দিয়ে যানটাকে কোনো ক্রমে বরফ-ঝরনা পার করিয়ে রাস্তার বাঁকের ওপারে দাঁড় করাল।

খারদুংলার পথে বরফমোড়া রাস্তা

ইকবাল জানাল, গতবছর এরকমই এক বরফ-রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ব্রেক করে দুর্ঘটনায় পড়েছিল একটি গাড়িÑ প্রাণহানি ঘটেছিল চার পর্যটকের। চারদিকে এক ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে একে অন্যের দিকে তাকালাম। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন হিমশীতল বরফের স্রোত বয়ে গেল।

|| ২ ||

লাদাখ গ্লেসিয়ারের বুক চিরে লে শহর থেকে চড়াই পথে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম লাদাখ গিরিশিরার ওপর। খারদুংলা টপে পৌঁছেই চোখে পড়ল নোটিশ বোর্ডে লেখা, এটাই বিশ্বের উচ্চতম মোটর-মার্গ, উচ্চতা ১৮,৩৮০ ফুট। যদিও আধুনিক অনুসন্ধানে তথ্যটি খারিজ হয়েছে। ডি জিপিএস পদ্ধতিতে জানা গিয়েছে এর উচ্চতা ১৭,৫৮২ ফুটের কাছাকাছি।

উত্তরে কারাকোরাম আর দক্ষিণে জাঁসকারের শ্বেতশুভ্র পর্বতমালা। পরিষ্কার নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে চলেছে, আর বরফ-মোড়া পাহাড়ের ওপর সূর্যরশ্মি পড়ে ঠিক যেন সাদা ক্যানভাসে এক চিরসুন্দর ছবি এঁকে চলেছে। প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে একহাতের গ্লাভ খুলে ক্যামেরার শাটার টিপছিলাম, কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম হাতের আঙুলগুলো ক্রমে অবশ হয়ে আসছে। তাপমাত্রা এখানে হিমাঙ্কের বেশ নিচে নেমে গিয়েছে (মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। এই অঞ্চলে দিনের বেলা সানগ্লাস ছাড়া চলাচল বিপজ্জনক, কারণ বরফের ওপর সূর্যালোকের তীব্র প্রতিফলন চোখের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক। পাশেই সিয়াচেনÑ চোখে পড়ল ভারতীয় সেনাবাহিনীর তাঁবু ও সেনাদের নিঃশব্দ চলাচল।

খারদুংলার ১৫ কিলোমিটার উত্তরে নর্থ পুল্লু, আর ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে সাউথ পুল্লু। দু’টোই সেনা শিবির। সাউথ পুল্লু হয়ে আমরা টপে উঠেছি। উতরাই পথে নর্থ পুল্লু, খারদুংলা গ্রাম হয়ে এবার আমাদের গন্তব্য নুব্রা ভ্যালি, প্রায় ১০০ কিলোমিটার যাত্রাপথ। শুরুর রাস্তা বেশ খারাপ। যেখানে-সেখানে ধস নেমে রাস্তা ভেঙেছে। পাশের পাহাড়প্রমাণ বরফ গলে পানিপ্রবাহ তৈরি হয়েছে আর সেই পানি-ভরা গভীর গর্তময় পথে গাড়ির চাকার পক্ষে এগনো বেশ কষ্টকর। নর্থ পুল্লুতে আসতে চোখে পড়ল সাদা পাহাড়ের গা-বেয়ে মিলিটারি সাঁজোয়া গাড়ির লম্বা সাড়ি ধীর গতিতে আমাদের দিকে আসছে। এখানে রাস্তা একমুখী। তাই তাদের যাওয়ার জায়গা করে দিতে ইকবাল আমাদের গাড়িটাকে সেনা শিবিরের কাছে দাঁড় করাল।

কর্তব্যরত ভারতীয় সেনা

সুযোগ বুঝে আমার লেখক-বন্ধুটি চেকপোস্টে কর্তব্যরত জওয়ানদের সাথে গল্প জুড়ে দিলো। আমরাও যোগ দিলাম সেই আড্ডায়। ঘটনাচক্রে জওয়ানদের একজন বাঙালি, নিবাস বোলপুর। এই পাণ্ডববর্জিত দুর্গম পাহাড়ে স্বজাতির দেখা পেয়ে স্বভাবতই সেই ফৌঁজি কিছুটা উৎফুল্ল ও আবেগতাড়ি হয়ে পড়ল। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ১৯৭৩ সালে পাসের ওপর এই রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন কিছু ভারতীয় জওয়ান। এই রাস্তা ধরে আরো ১৬৪ কিলোমিটার চললে সিয়াচেন বেসক্যাম্পÑ পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র। আর সেই বেসক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রসদ যায় এই পথ ধরেই। তাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই রাস্তার গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম। শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তখন রাস্তা ঢেকে যায় ১০ ফুট পুরু বরফের চাদরে। অতন্দ্র প্রহরারত এই ফৌজিদের দিনযাপন তখন হয়ে ওঠে আরো কঠিন ও দুর্বিষহ।

মিলিটারি গাড়ির সারি চলে যেতে বাস্তবের এই নায়কদের সালাম জানিয়ে আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। পাস থেকে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার উত্তরে খারদুং গ্রামে কয়েকটা দোকান পাওয়া গেল। ঘড়িতে দুপুর ১২টা। জুটল প্রাতরাশ। এর পরের রাস্তা অপেক্ষাকৃত ভালো। চারপাশের বরফের সাম্রাজ্য কমে ক্রমে সবুজের উপস্থিতি বাড়তে থাকল। পথে দেখা মিলল ইয়াক, ভেড়া ও কিয়াং বা বন্য গাধার। এ ছাড়া পথের ধারে তৃণভূমির মধ্যে ভোঁদর-সদৃশ হিমালয়ান মার্মটের দেখা পাওয়া উতরাই পথের বিশেষ প্রাপ্তি।

|| ৩ ||

খারদুংলা থেকে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার রাস্তা নেমে আমরা পৌঁছলাম খালসারে। সিয়াচেন হিমবাহের বরফগলা পানি তিরতির করে নুব্রা নাম নিয়ে কাছেই শিয়কে এসে মিশেছে। এই দুই নদী সৃষ্টি করেছে এক সবুজ উপত্যকার, যা নুব্রা ভ্যালি নামে খ্যাত। ‘নুব্রা’-র অর্থ ফুলের বাগান, ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারসÑ লাদাখের মরুদ্যান। এর গড় উচ্চতা ১০ হাজার ফুট। এখানে বহিরাগতদের পারমিট ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই লে-তে তৈরি পারমিটের এক কপি চেকপোস্টে জমা দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম নুব্রা উপত্যকায়, যা পৃথক করেছে লাদাখ ও কারাকোরাম পর্বতমালাকে। এখানে গম, বার্লি, সর্ষে ছাড়াও শীতের ফল আপেল, খুবানি ও আখরোটের চাষ হয়। স্থানীয় লোকেরা লাদাখি ভাষায় কথা বলে। বেশির ভাগ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও কিছু সংখ্যক শিয়া ও সুন্নি মুসলিমেরও বাস রয়েছে।

রাস্তা থেকে বরফ সরাতে ব্যস্ত BRO

খালসার থেকে দু’টি রাস্তার উপত্যকার দুই প্রান্তে চলে গিয়েছে। বাঁদিকের রাস্তা ধরে প্রায় ১৯ কিলোমিটার পূর্বে আমরা পৌঁছলাম উপত্যকার সব থেকে বড় গ্রাম দেসকিটে। এখানে দোকান-বাজারের সাথে পৌঁছে গিয়েছে ব্যাংক পরিষেবাও। প্রধান দৃষ্টব্য ৬০০ বছরের প্রাচীন দেসকিট-মনাস্ট্রি। মাথার ওপর পতপত করে উড়ছে বৌদ্ধদের রঙিন ধর্মীয় পতাকার সারি। এখান থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কে-২ দেখা এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। আরো সাত কিলোমিটার পথ চলার পর এক সরু নদীর ধারে ইকবাল আমাদের গাড়িটা থামাল।

গাড়ি থেকে নেমে আমরা এক আশ্চর্য দৃশ্যের সম্মুখীন। এতক্ষণ দূর থেকে দেখা ধূসর ন্যাড়া পাহাড়গুলো এখন খুব কাছে আমাদের চার দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাথায় বরফের আস্তরণে পড়ন্ত বিকেলের আলো পড়ে স্ফটিকের আকার নিয়েছে। রোদের তাপ বেশ চড়া হলেও কলকল শব্দে বয়ে চলা শিয়কনদীর পানি যেমন স্বচ্ছ, ততটাই ঠাণ্ডা। নদীর ওপর এক ছোট বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আমরা ওপারে পা রাখলাম।

সামনে পাহাড়ঘেরা ঢেউ খেলানো সাদা বালিয়াড়ির সমুদ্র। ইতস্তত ছড়িয়ে আছে কাঁটাগাছের ঝোপ। এটাই বিখ্যাত হুন্ডার। ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় ভারতের উচ্চতম মরুভূমি। এই শীতল মরুভূমিতে চরে বেড়াচ্ছে দুই কুঁজবিশিষ্ট লোমশ উট। এরা মধ্য এশিয়ার তাকলামাকান ও গোবি মরুভূমির ব্যাকট্রিয়ান উটের প্রজাতিভুক্ত। উটে চড়ে মরুভূমি-বিহার এই সফরে এক অন্য সাধের অনুভূতি। উট সওয়ারির খরচ প্রতি ১৫ মিনিটে ১৫০ টাকা। অল্প দূরেই তাঁবু ভাড়া পাওয়া যাবে রাত কাটাবার জন্য। মান অনুসারে ভাড়াও ভিন্ন। আমরা দু’টি সাধারণ মানের তাঁবু বেছে নিলাম। তাড়া তাঁবুপ্রতি ২,০০০ টাকা। লাদাখে দিনের আলো থাকে রাত আটটা পর্যন্ত। নৈশভোজ সেরে তাঁবুর জানালা দিয়ে রাতের মায়াবী আলোয় কালচে পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল টিম ম্যানেজার সুজিতদার হম্বিতম্বিতে হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ঘণ্টার কাঁটা ৮টা পেরিয়ে গিয়েছে। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে থাকলেও সকালের মিঠে আলোয় সমস্ত উপত্যকা যেন এক নির্মল স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ। মোমো ও স্যুপ দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে হুন্ডারকে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম পানামিকের উদ্দেশে।

নুব্রা ভ্যালিতে ব্যাক্টেরিয়ান উট

খালসার থেকে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে পানামিক পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েকের বেশি সময় লাগল। এখানে ভূগর্ভ ফুঁড়ে বিরামহীন ধারায় উঠে আসা উষ্ণপ্রস্রবণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পাথরের গায়ে বিচিত্র রঙের সৃষ্টি করেছে। শীতের দেশে প্রকৃতির গিজারে স্নান করার লোভ সামলাতে পারলাম না। পানামিকই লাদাখের শেষ গ্রাম, যে পর্যন্ত ভ্রমণার্থীদের যাওয়ার অনুমতি মেলে। এরপর এই রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে সিয়াচেন বেসক্যাম্পে। দূরত্ব ৯৪ কিলোমিটার।

|| ৪ ||

এবার ফিরতি রাস্তায় লে-তে ফেরা। সদ্য দেখা চোখজুড়ানো সব ছবিগুলো মাথায় ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। রুক্ষ দেখে সবুজের মরুদ্যান, ন্যাড়া পাহাড়ের কোলে শীতল মরুভূমি, তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী, উষ্ণপ্রস্রবণÑ একই সাথে প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ শুধু ভারতবর্ষেই নয় হয়তো-বা সমগ্র পৃথিবীতেই দুর্লভ। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। সন্ধ্যায় পৌঁছলাম লে।

সফর শেষ, এবার ঘরে ফেরার পালা। ১৯৮৯ সালে চালু হওয়া লে-মানালি রাজপথ, পোশাকি নাম ২১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মানালি পৌঁছতে সময় লাগবে দুদিন, দূরত্ব ৪৭৭ কিলোমিটার। কিন্তু এই দুই দিনের বৈচিত্র্যময় সফর লাদাখ ভ্রমণের ক্লাইম্যাক্স। ফিরতি পথে চোখে পড়ল ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় এক অদ্ভুত তেপান্তরের মাঠÑ মোরি মালভূমি। মালভূমি ও পাহাড়ের বুক চিরে বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের তৈরি করা রাস্তা ধরে চলেছি, পথে দেখলাম অসংখ্য বাদামি বর্ণের তিব্বতি গাধা। এরপর ১৬৭ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে প্যাং-এ (১৫,২০০ ফুট) তাঁবুর হোটেলে মধ্যাহ্নভোজ। তারপর এখান থেকে আরো ১০ কিলোমিটার এগিয়ে রাস্তার ধারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি পাথরের আর্চÑ ‘গেটওয়ে অব লাদাখ’ আমাদের বিদায় জানাল। আরো ১৪ কিলোমিটার চড়াই পার হলে লাচুংলা (১৬,৬১৬ ফুট)। এখান থেকে তীব্র উতরাই পথে ৫৭ কিলোমিটার দূরে সারচুতে (১৪,০০০ ফুট) জম্মু-কাশ্মীরের শেষ ও হিমাচল প্রদেশের শুরু। সারচু থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ কেলংÑ এখানে রাত্রিবাস করলাম। পরদিন রোটাং পাস (১৩,০৫৪ ফুট) হয়ে ১৮৮ কিলোমিটার দূরে মানালি (৬,৭২৬ ফুট), সেখান থেকে ফিরতি পথে দিল্লি ছুঁয়ে হাওড়ায় আমাদের যাত্রা শেষ।


শীতল মরুভূমি হুন্ডার

সফর শেষ হলেও এই ভ্রমণের বিচিত্র রঙিন ছবিগুলো মনের গভীরে গাঁথা থাকবে আজীবন। শুধু লাদাখের নৈসর্গিক প্রাকৃতিক শোভাই নয়, এই দুর্গম প্রতিকূল পরিবেশে গোটা যাত্রাপথে পরিচয় হওয়া লাদাখি মানুষদের অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও পরিবেশ সচেতনতা হৃদয় ছুঁয়েছিল। সম্ভ্রম জাগিয়েছিল সাদাসিধে মানুষগুলোর কঠিন জীবনের রোজনামচা। বিদায়বেলায় ইকবালকে আলিঙ্গন করে যেন এক আত্মিক বন্ধন অনুভব করেছিলাম। ছলছল চোখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইকবাল শুধু বলেছিল ‘আলবিদা দোস্ত’।


প্রয়োজনীয় তথ্য

কখন যাবেন
জুন থেকে সেপ্টেম্বর লাদাখের বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল। ভ্রমণের আদর্শ সময়। এই সময় লে থেকে মানালি ও শ্রীনগরের রাস্তাও খোলা পাওয়া যায়।

ইনারলাইন পারমিট
লে শহর সংলগ্ন দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখতে কোনো সরকারি অনুমতি লাগে না, তবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ শহর থেকে দূরে বেশির ভাগ জায়গাগুলোতে যেতে ইনারলাইন পারমিটের প্রয়োজন। লে-র ডিসি অফিসে পরিচয়পত্র ও ফটো জমা দিলে পারমিট পাওয়া যাবে। এর ৬-৭টা ফটোকপি যাত্রাপথে সাথে রাখুন। এগুলো যাত্রাকালে মিলিটারি চেকপোস্টে জমা দিতে হবে।

কিভাবে যাবেন
দিল্লি, শ্রীনগর ও চন্ডিগড় থেকে নিয়মিত বিমান যাচ্ছে লে বিমানবন্দরে। সেখান থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ঘেরা লে শহর। এ ছাড়া সড়কপথে শ্রীনগর থেকে লে-র দূরত্ব ৪৩৪ কিলোমিটার। মাঝে কারগিলে একরাত থাকতে হবে। মানালি থেকে কেলং-সারচু হয়েও লে-তে যাওয়া যায়। দূরত্ব ৪৭৩ কিলোমিটার। সময় লাগবে ২ দিন।

গাড়িভাড়া
লে ট্যাক্সি ইউনিয়ন দূরত্ব অনুসারে লাদাখের দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর জন্য নির্দিষ্ট ভাড়া ধার্য করে রেখেছে। ভ্রমণকারীরা প্রয়োজনমতো গাড়ি ও স্থান নির্বাচন করে যেতে পারেন।

একদিনে লে শহরের কাছাকাছি দ্রষ্টব্যগুলো দেখে নেয়ার জন্য গাড়িভাড়া পড়বে ৮৬০ টাকা। নুব্রা উপত্যকার ১ রাত ২ দিনের ট্রিপে খরচ পড়বে ৮,৩৬৯ টাকা। সো মোরিরি হ্রদে ১ রাত ২ দিনের ট্রিপে খরচ পরবে ৯,৩৪৫ টাকা। প্যাংগং হ্রদে ১ রাত ২ দিনের ট্রিপে খরচ পড়বে ৮,১৫৯ টাকা। দিনে দিনে প্যাংগং হ্্রদ ভ্রমণে খরচ পড়বে ৬,৮৫৪ টাকা। সকাল সকাল বেরিয়ে আর্যগ্রাম ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসার খরচ পড়বে ৬,১৫১ টাকা। সাথে আলচি গুম্ফা এবং লিকির গুম্ফা যেতে হলে আরো ৬০০ টাকা অতিরিক্ত লাগবে।

বেড়ানোর জন্য সুমো, কোয়ালিস বা স্করপিও জাতীয় গাড়ি নিতে হবে। একটি গাড়িতে ৬ জনের বেশি যাত্রী সাধারণত নেয়া হয় না। তবে মনে রাখবেন তেলের দাম কমা-বাড়ার সাথে গাড়িভাড়াও ওঠা-নামা করে। গাড়ির জন্য যোগাযোগ : সোনম শেরিং, ফোন- ০৯৪১৯৩-৭২৮১৭

কোথায় থাকবেন
লে শহরে থাকার জন্য কয়েকটি হোটেল হলো :
ইয়াক টেল (০১৯৮২-২৫২১১৮), ভাড়া ১,৮০০-২,০০০ টাকা।
হোটেল হিলটাউন, লে প্যালেস ও সিয়াচেনের ভাড়া ২,২০০-২,৭০০ টাকা। বুকিং : ৯৮৩০২-৫৮৮২৮।
হোটেল কাংরি (৯৪৩২০-১২১৩১), ভাড়া ২,২০০-৪,০০০ টাকা।
দেওয়াচান ইন্টারন্যাশনাল, থংসল গেস্টহাউস, ভাড়া ১,৫০০-২,৫০০ টাকা। বুকিং ২৪১৭-৪৫০১।
হোটেল ড্রিমল্যান্ড (৪০৬০-৫১৫২), ভাড়া ১,৪০০-২,২০০ টাকা।
গালোয়ান গেস্টহাউস (৯৪৩২৬-৪৯৯১২), ভাড়া ১,০০০-১,৫০০ টাকা।

মনে রাখবেন
লে শহরে পৌঁছে ১-২ দিন বিশ্রাম নিয়ে, উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নেয়া অত্যন্ত জরুরি। সাথে রাখুন হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোকা-৬ । প্রায় সবুজহীন লাদাখে অক্সিজেনের মাত্রা বেশ কম থাকায় উচ্চতাজনিত সমস্যা (যেমন মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, বমি ইত্যাদি) হয়। এখানে গরম জামাকাপড়ের সাথে নিতে হবে রোদটুপি, সান প্রোটেকশন ক্রিম, রোদচশমা ও ভেসলিন। ইনারলাইন পারমিটের জন্য প্রত্যেক সদস্যের ৬ কপি সচিত্র পরিচয়পত্র ও ভোটার কার্ড সাথে রাখা একান্ত আবশ্য। বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন লাদাখের সরকারি ওয়েবসাইট  www.leh.nic.in