পাথর বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। সবার আগে আশিস নেগি আর তাকে অনুসরণ করে আমরা। হাঁটার মাঝে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে পথের দু’পাশ নিরীক্ষণ করবার চেষ্টা করি। চরাচর জুড়ে মাঝরাতের নিঝুম অন্ধকার। শুধুমাত্র হেড ল্যাম্পের আলোয় যতদূর চোখ যায় তাতে বুঝি, দু’পাশে বড়সড়ও কোণ গাছ নেই। শুধু রডোডেনড্রন-এর ঘন জঙ্গল ছড়িয়ে রয়েছে। এখন জ্যৈষ্ঠের শেষ। তাই গাছে ফুল নেই। এপ্রিল-মে মাসে এই গাছগুলো যখন থোকা থোকা ফুলের বাহারে ভোরে ওঠে, তখন এই পথের প্রাকৃতিক শোভা শতগুণে বৃদ্ধি পায়। তখন লাল-গোলাপি রঙের পাহাড়ের মধ্য দিয়ে হাঁটা! আবার শীতের সময় এ রাস্তার ভিন্নরূপ। পুরো পথটাই তখন বরফের চাঁদরে মোড়া থাকে। তখন হাঁটু সমান বরফের উপর দিয়ে এক পা, দু’পা করে এগোতে হয়। ঝুরঝুরে নরম বরফে্র মোটা আস্তরনের ভিতরে পা গলে যেতে চায়। যদিও সেই পথে হাঁটা অপেক্ষাকৃত বেশী কঠিন! তথাপি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী পর্যটকদের কাছে সে পথে হাঁটার আস্বাদ অন্যরকম! তবে মাত্র আধ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করেই হৃদপিণ্ড এখন যে স্বাদ অনুভব করছে, তাকে মোটেও সুখদায়ক বলা যায় না! চড়াই ভেঙে এগোতে কষ্ট হচ্ছে। ভ্রূজগলি বুগিয়াল থেকে মাঝ রাতে যখন হাঁটা শুরু করেছিলাম তখনও বেশ ঠান্ডার কামড় বেশ ছিল! তাই ফুল স্লিভ জ্যাকেটের নীচে কডসুলের ইনার শরীর কামড়ে ছিল। শীত রাতে সে ওমের আদর দিচ্ছিল। আর এখন চড়াই ভাঙতে গিয়ে সেই ইনার-ই অসহনীয় লাগছে। ইনারের ভেতরটা ঘামে জবজব করছে। কিছুটা পথ হেঁটে আবার দাঁড়িয়ে পরি। বাতাস বেশ পাতলা! প্রতি নিঃশ্বাস অক্সিজেনের স্বল্পতা জানান দিচ্ছে। চোখ পড়ল অল্প অদূরে রাস্তার পাশে বেদিতে, পাথর আর সিমেন্টে বাঁধানো। সম্ববত এ পথের পথিক ও পূণ্যার্থীদের বিশ্রামের জন্য এগুলো তৈরী করা হয়েছে! সেখানে বসে দু’ঢোক জল পান করি। খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হয় চড়াই ভাঙা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছি কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। চোখের আরাম বলতে সামনের রাস্তার উপরে পরা হেডলাইটের আলোর বৃত্ত।

চলেছি চন্দ্রশিলার পথে। দিন চারেক আগে হরিদ্বার হয়ে মোটর পথে পৌঁছেছিলাম সারি গ্রামে। পরদিন রুকস্যাক পিঠে সেই গ্রাম থেকেই শুরু হয়েছিল হাঁটা। দেওরিয়াতাল-রোহিণী বুগিয়াল হয়ে গতকাল আমরা তাবু ফেলেছিলাম চোপতা সংলগ্ন ভ্রূজগলি বুগিয়ালে। আজ আমাদের সামিট ডে। অর্থাৎ চন্দ্রশিলায় আরোহণের দিন।

পথের বাঁকে এসে হঠাৎ হাঁটা থামল। এখান থেকে চাঁদকে দেখা না গেলেও চাঁদের আলোয় উত্তর আকাশে উদ্ভাসিত হয়েছে বরফাবৃত শৃঙ্গরাজি। যেন এই শহুরে পথিকদের ওরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে! চোখ সরিয়ে মাথার ইপরে ঈশান কোণে তাকাতে উপরে কিছু বাতিস্তম্ভ চোখে পড়ল। আলোগুলো পাহাড়ি পথ ধরে সারি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। তবে কি তুঙ্গনাথ মন্দির এর কাছে আমরা চলে আসলাম! ভুল ভাঙায় গাইড ভাই আশিস। ওটা বনদপ্তরের গবেষণা কেন্দ্র। আসলে চোপতা থেকে চন্দ্রশিলা – এই পুরো পথটাই ‘কেদারনাথ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি’ এর মধ্যে পড়ছে। বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রাণী ও পাখির আবাস এই বিজন পাহাড়ে। আর উচ্চ হিমালয়ের এই স্যাংচুয়ারির বন্যপ্রাণ ও গাছপালা নিয়ে এই রিসার্চ সেন্টারে অমূল্য গবেষণা চলে।

এক সময় রাস্তাটা দু’দিকে ভাগ হল। সোজা রাস্তাটা রিসার্চ সেন্টারের দিকে চলে গিয়েছে। আর ডান দিকের রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে মন্দিরের দিকে। আমরা ডাইনের রাস্তাটাই ধরলাম। হঠাৎ পিছনে তাকাতেই দেখি বিন্দু বিন্দু আলোর সরণি রাস্তা বেয়ে যেন উপরের দিকে উঠে আসছে! গতকাল বিকেলে লোয়ার ভ্রূজগলি বুগিয়ালে কিছু ট্রেকারদের সাথে দেখা হয়েছিল। গতকাল সেখানে তারা টেন্ট পিচ করেছিলেন। সম্ববত ট্রেকারদের সেই দলটিই এখন চন্দ্রশিলা পাহাড়ের পথে উঠে আসছে। আর তাদের মাথায় লাগানো হেডল্যাম্পগুলো আলোকবিন্দুর চলমান সরণী সৃষ্টি করেছে। উপরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার পাহাড়ের বুকে জ্যোতিবিন্দুদের এই সর্পিল গতি দেখতে বেশ লাগছে!

আরও বেশ কিছুক্ষন হাঁটার পর উত্তর আকাশ আবার চোখের সামনে হাজির। এতক্ষন একটা পাহাড়ের ডান দিক ধরে হাঁটছিলাম। তাই উত্তর দিক চোখের আড়ালে ছিল। সেই পাহাড় টপকাতেই আকাশের উত্তর আর ঈশান কোন এখন আবার চোখের সামনে। কিন্তু এ কেমন দৃশ্য! খানিক আগেই চাঁদের আলোয় যে চৌখাম্বা নন্দা দেবী আর কেদার ডোম শৃঙ্গদের দেখলাম, এখন তারা বেমালুম গায়েব! কোথা থেকে যেন এক পাল মেঘ এসে আবার তাদের ঢেকে দিয়েছে। মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠল! আবহাওয়া খারাপ হলে সব পরিশ্রম জলে যাবে। আকাশের মন বোঝা সত্যিই ভার! এ যেন শ্রাবণের জ্যোৎস্না রাতে সমুদ্রের পারে বসে আছি! এই আকাশ তারায় ভরে ওঠে, তো পরক্ষনেই আবার বেয়াদপ মেঘেদের জলসা। প্রকৃতি যেন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলে চলেছে!

আশিস-এর নির্দেশে হেড লাইটের আলোটা বন্ধ করে দিলাম। ধাতস্থ হতে চোখ খানিক সময় চাইল। ধীরে ধীরে চারপাশ দৃষ্টির গোচরে আসল। সামনের পাথুরে রাস্তা, ডান দিকে পাহাড়ের চাটটান, পথের বাঁদিকে নেমে যাওয়া খাদ – স্পষ্ট না হলেও সব কিছুই ভাসা ভাসা দেখা যাচ্ছে । মাথা উঁচু করতেই দেখি, পূব দিকের এক মস্ত পাহাড়ের মাথার উপর দিয়ে চতুর্থীর চাঁদ উঠেছে। এতক্ষণ বুঝি সে ঐ পাহাড়টার আড়ালে লুকিয়ে ছিল! খানিক উচ্চতা আরোহণে সে এবার ধরা এই পথিকদের কাছে দিয়েছে। মাথার উপর টিমটিমে চাঁদ আর সমস্ত আকাশ জুড়ে চকমকি তারারা যেন এক ঝাঁক জোনাকির মতো ঝিলিমিলি করছে! এখন চাঁদের আলোয় গা ভিজিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ নীচের দিকে পিছনে ফেলে আসা পাহাড়ের দিকে চোখ গেল। কালচে সবুজ পাহাড়ের শরীরে জ্যোৎস্নার সুধাধারা ঢেলে দিয়েছে চাঁদ। চন্দ্রমার ধোঁয়া ধোঁয়া নীলচে আলোয় আজ ভীষণ মায়াবী হয়ে উঠেছে গাড়োয়ালের এই নিঝুম পাহাড়। কে বলে, চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আছে! চাঁদের পানে তাকাতেই নজরে পড়ল মাথার উপরে পচাত্তর ডিগ্রী কোনে যেন এক কংক্রিটের চুড়া! চুড়ার মাথায় পতাকা বাঁধা।

আশিস জানাল, ওটাই তুঙ্গনাথ মন্দির। চুলের কাটার মত প্রায় এগারোটা পাহাড়ি বাঁক পেরিয়ে এক সময় পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছে। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটে। এখনও সকাল হয়নি, তাই মন্দিরের গেট এখন বন্ধ। মন্দিরকে পাশ কাটিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে আমরা এগিয়ে যাই। ভ্রূজগলি বুগিয়াল, যেখান থেকে আজকের হাঁটা শুরু করেছিলাম, তার উচ্চতা প্রায় ৮,৯০০ ফুট। আর এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি অর্থাৎ মন্দির ১২০৭৩ ফুট উচ্চতায়। হিসেব কষে দেখি, এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিটে আমরা প্রায় ৩২৫০ ফুট উচ্চতা আরোহন করেছি, যা আমার মতো অলস বাঙালির পক্ষে নিতান্ত সহজ ব্যাপার নয়। এই বাহাদুরিতে বাঙালি ট্রেকারের হৃদয়ের প্রকোষ্ঠগুলো যখন আত্মতুষ্টিতে টগবগ করছে, সিলিন্ডার আকৃতির বুকের ছাতি যখন গর্বে ইঞ্চি দুয়েক ফুলে গিয়েছে, ঠিক তখনই দুশ্চিন্তার কথাটা শোনাল গাইড ভাই- এখান থেকে চন্দ্রশিলা পাহাড়ের শীর্ষদেশ আরও প্রায় দেড় ’কিলোমিটার দূরত্বে। তবে সে পথ সিমেন্ট বাঁধানোও নয়। আগের মতো সহজও নয়। অপেক্ষাকৃত দুর্গম আর চড়াই বেশী। মাঝে মধ্যে সে খাড়াই আবার বেশ তীব্র। তাই আমাদের আরও দ্রুত পা ফেলে চালাতে হবে। নচেৎ সূর্যোদয় অর্থাৎ সাড়ে পাঁচটার আগে চন্দ্রশিলার শীর্ষে পৌঁছানো কোনভাবেই সম্ভব হবে না। এ কথা শুনে বুকের ছাতি আবার চুপসে যায়। কপালে ভাঁজ। বলে কি এই ছোকরা! এই চড়াই ভাঙতেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে আসার জোগাড়! আর এরপর নাকি আরও বেশি খাড়াই পথ, আরও গতি বাড়িয়ে হাঁটতে হবে! এবার রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করছে। রক্তচাপ ঊর্ধ্বমুখী। গতকাল সন্ধাতেই কিচেন টেন্ট ডিনারের সময় ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আজকের পথের কথা। তখন রুটি চিবতে চিবতে নির্লিপ্ত স্বরে ও বলল, “কুছ ফিকার নেহি সাবজি, পৌঁছ জায়েঙ্গে”। আর ব্যাটা এখন মাঝপথে এসে উলটো সুর গাইছে! ও কী আমাদের তেনজিং নোরগের পাশের বাড়ির শেরপা ভেবেছে! নাকি আট হাজারি পাহাড় সামিট ফেরত ক্লাইম্বার ভেবেছে! একে চড়াই ভাঙতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে! তার ওপর এখন রাগের চোটে যেন শরীরের রক্তচাপ যেন বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। পরক্ষনেই ভাবি, ও যা বলছে তা তো আমাদের ভালোর জন্যই বলছে! আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে যাতে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারি, সে জন্যই তো অপ্রিয় হলেও সত্যটা বলছে। পথে যখন নেমেই পড়েছি তখন আর ভাবনা কিসের! তাই, চরৈবেতি… এগিয়ে চলো হে পথিকবর।

এখন এবরো-খেবরো পাথুরে রাস্তা ধরে চলেছি। রাস্তা ক্রমশ খারাপ, আরো খারাপ হচ্ছে। একটা সময় চারদিক ন্যাড়া হতে শুরু করল। পথের দু’পাশের পাহাড়ে আর সবুজের সান্নিধ্য নেই। রুক্ষ পাহাড়ের গা বেয়ে সাবধানে পা ফেলে চলা। মুহূর্তের ভুল মানে হয় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ে থাকা, নয়তো পাশের অতলান্ত খাদে পড়ে হিমালয়ের চরণে চির সলিল সমাধি। প্রায় মিনিট কুড়িঁ পথ চলার পর আশিস বলে, “ইয়ে স্পিড মে চলনে মে হাম টাইমমে কভি পৌঁছ নেহি পায়েংগে।” এখন ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা আর তিরিশ মিনিট পরেই হবে সূর্যোদয় আর এই সময়ের মধ্যে যদি পৌঁছতে না পারি তবে সেই পাহাড় চূড়ায় স্বর্ণালী মুহূর্তের সাক্ষী হওয়া এ জীবনে হয়ত অধুরা থেকে যাবে!

এরপর আশিস রাস্তা ছেড়ে শর্টকাট পথ ধরল। পথ বলতে পাহাড়ের প্রায় সত্তর ডিগ্রী খাড়া ঢাল বেয়ে ওঠা। কিন্তু হাঁচরপাচর করে খানিক চড়াই ভাঙার পরে বুঝি, এই হ্রস্বতর তীব্র খাড়াই পথ এই গৃহীজিবি বাঙালির জন্য নয়। তাই শর্টকাট ছেড়ে আবার পাথুরে রাস্তা ধরি। জনা কয়েক ট্রেকার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়। হাতে আর বিশেষ সময় বাকী নেই। পথচলায় এবার গতি না আসলে চন্দ্রশিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের সেই অমোঘ দর্শন এ জীবনে হয়ত অধুরাই থাকবে! আশিসকে আর দেখা যাচ্ছে না। ও হয়ত সেই শর্টকাট পথ ধরেই উঠে গিয়েছে! এতক্ষণে হয়তো শীর্ষে পৌঁছেও গিয়েছে। তুঙ্গনাথ থেকে চন্দ্রশিলা মাত্র দেড় কিলোমিটারের পথ হলেও এই রাস্তা অঙ্কের কিলোমিটার-এ মাপা মানে যে কতখানি ভুল তা যারা অন্ধকার রাতে এই পথে এসেছেন তারাই কেবল জানেন। হাঁটতে হাঁটতে মাথা উঁচু করতেই একসময় সিলুটে দেখতে পেলাম এক পাথরের ছোট মন্দির, মন্দিরের মাথায় পতাকা উড়ছে। অনুমান করি, ওটাই হয়ত চন্দ্রশিলার রাম মন্দির। এই পাহাড়ের শেষতম বিন্দু। তার মানে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি। মনটা আনন্দে ভরে উঠল! আর দূর নয়! প্রাণান্তকর চড়াই ভেঙে আরও কিছু সময় পর ছুঁয়ে ফেললাম মন্দির। পৌঁছে গেলাম চন্দ্রশিলা পাহাড়ের শীর্ষে, যার উচ্চতা ১৩,১২০ ফুট। ঘড়িতে এখন পাঁচটা বেজে তেইশ মিনিট। অর্থাৎ, সূর্যোদয়ের আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে সমর্থ হয়েছি। মন যেন তার আকাশ খুঁজে পায়! রাম মন্দির-এর পেছনে খানিক সমতল। বেশ কিছু ট্রেকার্স ইতিমধ্যেই নোঙর ফেলেছে সেখানে। দেখা হল আশিস-এর সাথে।

মন্দিরের বাঁ দিকে অর্থাৎ উত্তর আকাশের সীমানায় একের পর এক শৃঙ্গ চাঁদের নিভৃত আলোতে ঘুমিয়ে রয়েছে। আর পূবাকাশের দিকচক্রবালে হালকা কমলা আভা। সময় যত গড়াল সেই আভাও তত জোরালো হতে লাগল। আর পূব আকাশের আলো যত জোরালো হতে থাকল, উত্তর আকাশ ততই স্পষ্ট হতে লাগল। একসময় পূবের দিগন্ত রেখায় কালচে পাহাড়ের পিছন থেকে সোনাঝরা দ্যুতির ছটা আকাশের মাথায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। এতক্ষণ যে সাদা মেঘের দল ঘুমন্ত পাহাড়চূড়ার মাথায় স্থির হয়ে ভেসে ছিল, তাদের শরীরে কে যেন সোনার তবক পরিয়ে দিতে লাগল! নীচের পাহাড়ের গভীরে এখনো জমাট অন্ধকার। আলো-আঁধারির মায়া খেলায় এক অদ্ভুত মোহময়ী কাকভোরের এই হিমালয়! উত্তর আকাশে পাহাড় আড়াল করে থাকা মেঘেরা আবার সরে গিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চৌখাম্বা, নন্দাদেবী, ধুলাগিরি, নীলকণ্ঠ আরো অনেক শৃঙ্গ। হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে। ভোরের নরম আলো ওদের ঘুম ভাঙাচ্ছে ! পায়ের নীচে একের পিছনে আর একটা পাহাড়। যেন ওরা ছুটে চলেছে অসীমের পানে! অতলান্তিক মহাসাগরের সুনির্মল ঢেউ রাশি যেন কোন এক দিব্যগ্যানী ঋষির শাপে হঠাৎ থমকে গিয়েছে! মেঘ আর কুয়াশা জড়ানো অপস্রিয়মান পাহাড়রাশি দূরে মিলিয়ে গিয়েছে দিগন্তরেখায়। দূষণহীন প্রকৃতির শরীরে রংবেরঙের আলো ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের গায়ে, কুয়াশার শরীরে। শরীরী বিভঙ্গ ভাষায় কি অনায়াস বিশ্ব প্রকৃতির ছন্দ! আর চারিপাশে এক অপার-অনন্ত নৈঃশব্দ! কোন কথা না বলেও চোখের ভাষা যেমন অনেক কিছু বলে দেয়, তেমন-ই কাকভোরের এই নিস্তব্ধতাও আজ এঁকে চলেছে হাজারো ভোরাই সুরের ক্যানভাস। মনের মনিকোঠা ভেসে যাচ্ছে নির্বাক চলচ্ছবির এক মরমিয়া স্রোতে। ভাবি, নিস্তব্ধতা কখনো কখনো যে এত বাঙময় হয়ে উঠতে পারে, তা এই পাহাড়ের মাথায় না আসলে বুঝি এ জীবনে বোঝা সম্ভব হত না! পূব আকাশে সিলুট রুপে চেনা-অচেনা শৃঙ্গমালা। একমাত্র এই চন্দ্রশিলার মাথায় দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রী কোনে গাড়োয়াল আর কুমায়ুন হিমালয়ের এতগুলো নামজাদা পাহাড়চূড়াদের একসাথে দেখা যায়। অবশ্য যদি না আকাশের মুখ ভার থাকে। প্রকৃতি যেন তার অকৃপণ হাতে আজ নিজের সব ঐশ্বর্য নিয়ে হাজির হচ্ছে এই শহুরিয়াদের সামনে!

রাম মন্দির

কয়েক মুহূর্ত পর মনে হল যেন পূবের আকাশে কেউ হাজার হাজার ভোল্টের গনগনে আগুন জ্বেলে দিল! অগ্নি কোনে তখন ঝুলে থাকা লালচে চাঁদ পাহাড়ের কোলে ঢোলে পড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর প্রভাতের রবি তাকে বিদায় জানাবার জন্য আগমন সংকেত দিচ্ছে। এবার শুধু মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। অল্প সময় পরেই হাজির সেই শ্বাস রুদ্ধ করা মুহূর্ত ! হঠাৎ যেন এক টুকরো হিরে সিলুট পাহাড়ের পিছন দিয়ে লাফ দিয়ে বের হল! আর কামেট শৃঙ্গের উপর দিয়ে সূর্যের প্রথম আলো সিঁদুরে লাল রঙ বেশে ঠিকরে পড়ল চোখে, আকাশের মাথায়। তারপর সেই সোনা গলা আলো একে একে আছড়ে পরল নীলকন্ঠ চৌখাম্বা, জনহ্নকুট, কেদার ডোম আরও সব চেনা – অচেনা শৃঙ্গের বরফ চূড়ার মাথায়। পলকের জন্যও চোখের পাতা পড়ছে না। নিঃশ্বাস যেন আটকে রয়েছে এই আচম্বিত নয়নাভিরাম দৃশ্যপটে! এই বিরল মুহূর্তের সাক্ষী হতেই তো শত সহস্র যোজন পথ পেরিয়ে আসা, এত কষ্ট সহ্য করে রাতের অন্ধকারে তীব্র চড়াই ভাঙা। যারা দিনের আলোতে চন্দ্রশিলায় আসেন, তারা হয়তো বরফাবৃত শৃঙ্গ দেখতে পান! কিন্তু এই ম্যাজিক মোমেন্টর অনুভূতি তাদের ভাবনার অন্তরালে রয়ে যায়। ওদিকে সূর্যের আলো নীচের পাহাড়ের গভীরেও তখন রঙের বৃষ্টি ছড়াতে শুরু করেছে। হঠাৎ আশিস পাশে এসে দাঁড়ায়। পায়ের নীচে, বাঁ দিকে অদূরে যে কালচে-সবুজ পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে সেই পাহাড়টার দিকে হাত দেখিয়ে বলে, ওটা রাবনশিলা। রাবন ওখানে দীর্ঘ তপস্যা করে মহাদেবের বর লাভ করেছিলেন। আর এখন আমরা যে পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, এখানেই প্রভু রাম, রাবনকে পরাজিত করার পর ধ্যান করেছিলেন। এবার তার চোখের দিকে চেয়ে বলি, এই পাহাড়ের কী মহিমা দেখ- একই সাথে রাম আর তাঁর চিরশত্রু লঙ্কাধিপতি রাবন, অর্থাৎ রামায়নের দুই পরম বীর যোদ্ধাই এই পাহাড়ে এসেছেন। আসলে উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে অজস্র কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে সেরকমই এক কিংবদন্তি এই চন্দ্রশিলা। পুরানে আছে, আমরা এখন যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি সেই পাহাড়ে বসে দেবতা চন্দ্র একসময় তপস্যা করেছিলেন। তাই এই পাহাড়ের নাম হয়েছে চন্দ্রশিলা।

৩৬০ ডিগ্রী প্যানারমিক ক্যানভাস – মেঘেদের ভ্রুকুটি ঠেলে আজ চোখের সামনে হাজির গারোয়াল আর কুমায়ুন পর্বতমালার সেলিব্রিটি শৃঙ্গরা – হাতি পর্বত, ত্রিশূল, দুনাগিরি, নন্দাদেবি, কেদারডোম,
ভাগীরথী, মন্দানি, জনহোকুট, চৌখাম্বা আরও কত কী! যেন ওরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে! মর্তবাসীর এই অতিথিদের অভ্যর্থনায়! সকলের চোখেমুখে আজ শৃঙ্গজয়ের তৃপ্তির আনন্দ। সূর্যোদয়ের পরশমণি স্পর্শে আজ পথের সমস্ত ক্লেশ মুছে গিয়ে মুখমন্ডলে যেন এক আনন্দ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়েছে!

নজর গেল চন্দ্রশিলার পাহাড় চূড়ার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পাথরের মন্দিরে। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। গুটিগুটি পায়ে তার কাছে যাই। পাথর সাজিয়ে কয়েক ধাপ উঁচুতে মন্দিরটি। দুই ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে তোরণদ্বার টপকে ছোট্ট মন্দির, আপাদমস্তক পাথরের তৈরি, ছাদ স্লেট পাথরের । ভেতরে শিবের অধিষ্ঠান। মন্দিরের পাশে পাহাড়ের ঢালে মার্বেল পাথরে এক বেদি।। বেদির উপর আকাশের নীচে স্থাপিত রয়েছে এক পাথরের শিবলিঙ্গ যার মাথায় পাঁচটি শিবের মূর্তি। জনশ্রুতি, রাবণকে বধ করার পর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই রাম এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই মন্দিরটি খোলা থাকে। শীতের সময় যখন এই পাহাড় পুরু বরফের চাদরে ঢেকে যায় তখন দেবতাকে উখিমঠে স্থানান্তরিত করা হয়।

কখন যেন মেঘ নেমে এসে ঢেকে দিয়েছে উত্তর দিগন্তের শৃঙ্গদের! আশিস জানায়, এবার নীচে নামতে হবে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উতরাই পথে নামতে থাকি। রুক্ষ পাহাড় আবার সবুজের প্রলেপ পড়ছে। সকালের রোদ খেলা করে ঘাসের উপর। তার মাঝে ইতিউতি হাসি ছড়াচ্ছে এলপাইন ফুলের দল। তবে নীচের বুগিয়াল-এর সবুজ আর এই সবুজের মধ্যে তফাত বিস্তর। এই পাহাড়ের ঘাস শতমূলী রঙের। আসলে মার্চ মাস পর্যন্ত এই পাহাড় বরফের চাদরে শীতঘুম ছিল। মাস দুই হল এ পাহাড়ের ঘুম ভেঙেছে। তদুপরি, রাত নামলে এখানকার তাপমাত্রা বেশ নেমে যায়। আবার দিনের বেলায় ন্যাড়া পাহাড়ের শরীরে চড়া রোদের শাসন! দিনরাতে তাপমাত্রার এই পার্থক্যই হয়ত প্রভাব ফেলেছে পাহাড়ের শরীরে। তাই হয়ত ঘাসেদের এই রামধনু সাজ! দূর থেকে দেখি এক অন্য দৃশ্য! সকাল-রোদের পরশ পেয়ে পাহাড়ের গভীরে জমে থাকা মেঘেদের ঘুম ভাঙেছে। সাদা মেঘের দল ভেড়ার পালের মত কুলকুল করে পাহাড় ঠেলে উপরে উঠছে। লঙ্কাধিপতি যেন ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে ধ্যানে বসেছেন! কালচে সবুজ পাহাড়ের ব্যাকড্রপে খুব মিষ্টি লাগছে অভ্র মেঘেদের এই রক ক্লাইম্বিং! এই মায়াবী পাহাড়কে দেখতে দেখতে ভাবি, এতদিন শোনা গল্প যা বিন্দুবিন্দু স্বপ্নের শিশির জল হয়ে জমা হচ্ছিল মনের ভেতরে, আজ যেন তা ফল্গু নদী হয়ে বয়ে গেল! আর কী আশ্চর্য পুরানের এই গিরিকন্দর! রামায়নের দুই চিরশত্রু বীরশ্রেষ্ঠ এই একই পাহাড়কে তাঁদের ধ্যানের উপযুক্ত স্থান্রুপে বেছে নিয়েছিলেন। এ এক অনাঘ্রাতা পথ, যেখানে পাপ আর পূন্য একই পাহাড়ে এসে মিশে গিয়েছে। পিছন থেকে গাইড ভাই তারা লাগায়। উতরাই পথে সহজেই নামতে থাকি। আগামীকাল আবার অন্য এক পাহাড়! হয়তোবা অপেক্ষায় অন্য এক প্রকৃতি, আরও এক পুরান কথা! মুসাফিরের দাস্তান… শেষ হয়েও হয় না।